হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা- পর্ব-০৬ - আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা
আসসালামু আলাইকুম! প্রিয় পাঠক, আজকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করার ধারাবাহিকতা হিসেবে আমি আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশায়াল্লাহ।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের ধর্মীয় অবস্থা, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সাংস্কৃতিক অবস্থা, জাহেলি যুগ কাকে বলে, আইয়ামে জাহেলিয়া শব্দের অর্থ কি? আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কাল কত? কোন সময় কে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয়?
ইসলাম পূর্ব যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয় কেন? এই সকল বিষয় গুলো আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে। তাই আপনি যদি এই সকল বিষয় গুলো জানতে চান, তাহলে এই পোস্টটি আপনার জন্য পারফেক্ট হবে। তাই জাহেলি যুগের ঘটনা জানতে হলে এই পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
পেইজ কন্টেন্ট সূচিপত্রঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা- পর্ব-০৬ - আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা
- আইয়ামে জাহেলিয়ার গুরুত্ব pdf
- আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা
- জাহেলি যুগ কাকে বলে? আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থ কি?
- আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কাল কত?
- আইয়ামে জাহেলিয়ার বৈশিষ্ট্য - আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য
- আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীর অবস্থা
- আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানের অবস্থা
- ইসলামে কন্যা সন্তান ও নারীর মর্যাদা
- আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা
- শেষ কথা
আইয়ামে জাহেলিয়ার গুরুত্ব pdf
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ছিল চরম অজ্ঞতা, বর্বরতা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও আরবের লোকদের মাঝে সভ্যতার কোন আলো পোঁছায়নি। সেই সময় আরবে বিদ্যমান ছিল বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা।
আইয়ামে জাহেলিয়ার গুরুত্ব কি? বা কেন আইয়ামে জাহেলিয়া সম্বন্ধে জানবেন? কারণ স্কুল-কলেজের বিভিন্ন সিলেবাসে থাকে, আইয়ামে জাহেলিয়া কি? আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে কি বুঝ? জাহেলি যুগ কাকে বলে? আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে কি বুঝ? আইয়ামে জাহেলিয়ার পরিচয় ও সময়কাল, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সাংস্কৃতিক অবস্থা, আইয়ামে জাহেলিয়া আভিধানিক অর্থ কি?
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীর অবস্থা কেমন ছিল? প্রাক-ইসলামী আরবের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও, প্রাক-ইসলামী আরবের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ দাও।
এই সকল বিষয়গুলো বিভিন্ন পরীক্ষায় থাকে। তাই এই সকল বিষয়গুলো সকলেরই জানা প্রয়োজন। তাই এই সকল বিষয় গুলো জানতে হলে এই পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা
ইতোপূর্বে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের ধর্মীয় অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাই আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের ধর্মীয় অবস্থা বা প্রাক আরবদের ধর্মীয় অবস্থা সম্বন্ধে আবারও জানতে চান, তাহলে এই লিংকে ক্লিক করুন। আর আজকে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা নিয়ে কিছু আলোচনা করা হবে।
তৎকালীন আরব সমাজে অর্থাৎ আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা ছিল। অভিজাত শ্রেণির পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা এবং ন্যায় ভিত্তিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং মেলামেশায়র ক্ষেত্রে এমন সব ঘৃণ্য ব্যবস্থা এবং জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল, যাকে অশ্লীলতা, পাবিকতা এবং ব্যভিচার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
জাহেলি যুগ কাকে বলে? আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থ কি?
আইয়ামে জাহেলিয়া কাকে বলে? আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থ কি? আইয়ামে জাহেলিয়া শব্দটি আরবি শব্দ। আইয়াম শব্দের অর্থ যুগ বা সময়। আর জাহেলিয়া শব্দের অর্থ অজ্ঞতা, বর্বরতা, তমসা, কুসংষ্কার বা অন্ধকার ইত্যাদি। সুতরাং আইয়ামে জাহেলিয়া শব্দের অর্থ অজ্ঞতার যুগ। আর এই অজ্ঞতা, বর্বরতা, অন্ধকার, কুসংস্কারের যুগকে জাহেলি যুগ বলে।
ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে যখন আরবের লোকেরা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, তখন আরবদের মধ্যে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত ছিল। আর এই সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বলা হয়।
ঐতিহাসিক পি.কে. হিট্টির মতে, “প্রকৃত পক্ষে জাহেলিয়া বলতে সেই যুগকে বোঝায়, যে যুগে আরবে কোন নিয়ম কানুন ছিল না, কোন নবীর আবির্ভাব ঘটেনি এবং কোন ঐশী কিতাব নাজিল হয়নি।” আশা করি, বুঝতে পেরেছেন যে জাহেলি যুগ কাকে বলে।
আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কাল কত?
আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কাল কত? কোন সময় কে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয়? ইসলাম পূর্ব যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয় কেন? এ নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। যেমন-
- কোন কোন ঐতিহাসিক ব্যক্ত করেছেন যে, হযরত আদম (আঃ) এর সময় থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াত লাভের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বলা হয়। তবে এই মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। এই দীর্ঘ সময়ে মানুষকে হেদায়েতের জন্য অসংখ্য নবী-রাসূলের আগমন হয়েছে।
- আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত ঈসা (আঃ) এর ইন্তিকালের পর থেকে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগ বলা হয়।
- ঐতিহাসিক পি.কে, হিট্টি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকাল সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলে উল্লেখ করেছেন।
আইয়ামে জাহেলিয়ার বৈশিষ্ট্য - আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সার্বিক অবস্থা ছিল বিকৃত, কুসংস্কৃারাচ্ছন্ন, ধর্মহীনতা, নাস্তিকতায় পরিপূর্ণ। আর এখন আমি আইয়ামে জাহেলিয়ার বৈশিষ্ট্য ও আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো ইনশায়াল্লাহ।
পোত্তলিকতাঃ ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মের বহু পূর্বেই আরবদেশ পোত্তলিকতায় পূর্ণ হয়েছিল।
মূর্তি পূজার প্রচলনঃ ধর্ম-ব্যবস্থা ছিল চরম অবহেলিত। ঘৃণ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা, বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। জাহেলি যুগের আরবগণ বিভিন্ন মূর্তি-পূজা করতো। উপাসনাকারীগণ তাদের নিজের ইচ্ছে মতো করে মূর্তি গুলোর আকৃতি বানাতো।
বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীঃ জাহেলি যুগে যেসব ধর্মের অনুসারীরা আরবদেশে বসবাস করতো, তাদের মধ্যে ছিল ইহুদী, খ্রিস্টান, পোত্তলিক, দাহরিয়া, জড়বাদী, হানীফ প্রভৃতি।
কাবাগৃহে মূর্তি স্থাপনঃ জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থা এতোটা নিচে নেমে গিয়েছিল যে, পবিত্র কাবাগৃহে বিভিন্ন মূর্তি-পূজা স্থাপন করে।
বিভিন্ন ধর্মীয় কুসংস্কারঃ জাহেলিয়া যুগে মূর্তি-পূজার পাশাপাশি আরবদেশ বিভিন্ন কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল।
হজ্জ পালনঃ জাহেলিয়া যুগে আরব দেশের লোকদের মাঝে হজ্জ পালন খুব পূণ্যময় কাজ বলে বিবেচনা করা হতো। তবে হজ্জ পালন ব্যবস্থা এতটা বেহায়াপনার চরমে উঠেছিল যে, হজ্জ আদায়ের জন্য যারা কাবা ঘরে আসতো, তাদের একাংশ নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে কাবাকে তওয়াফ করতো।
সৌরজগতের পূজা প্রচলনঃ জাহেলিয়া যুগের আরবে বসবাসকারীগণ সৌর জগতের তথা চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্র প্রভৃতিকে প্রভুজ্ঞান মনে করে পূজা করতো।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীর অবস্থা
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীর অবস্থা কেমন ছিল? তা জানার জন্য এই পোস্টটি সম্পূৃর্ণ পড়ুন। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে পৃথিবীর অন্যান্ন দেশের তুলনায় আরবদেশে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সেই সময় নারীরা ছিল শুধু পুরুষদের ভোগের সামগ্র।
নারীরা অত্যন্ত অবহেলিতঃ আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে সামাজিক কোন পদমর্যাদায় নারীদের কোন অধিকার ছিল না। নারীদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হতো। নারীরা ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। বিবাহ প্রথা বলতে কিছুিই ছিল না। তাদেরকে শুধু ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিতঃ আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের নারীদের মৃত স্বামী, পিতা বা অন্য কোন আত্মীয় স্বজনের নিকট থেকে সম্পত্তির উপর কোন অধিকার ছিল না। তারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো। এছাড়াও নারীরা কোন অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারতো না।
দাস-দাসীর অবস্থাঃ সমাজে দাস-দাসীদেরকে অত্যন্ত দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন-যাপন করতে হতো। প্রাচীন কাল থেকেই আরবদেশে ক্রীতদাস প্রথা বিদ্যমান ছিল। ক্রীতদাসদেরকে পশুর সমতুল্য মনে করা হতো। তাদেরকে হাটে-বাজারে পন্যের মতো করে কেনা-বেচা হতো।
দাস-দাসীদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল এবং তা যদি কেউ লঙ্ঘন করতো, তাহলে তা দন্ডনীয় আপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। এছাড়া মনিবরা দাস-দাসীদের সাথে নানা অনাচার, অত্যাচার, পাপাচার ও ব্যভিচারে লিপ্ত হতো।
এই সব পাপাচার-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যপারে তাদের কোন লজ্জাবোধ কিংবা অপরাধবোধ সৃষ্টি হতো না।
বিবাহ প্রথা বা বহুবিবাহঃ জাহেলিয়া যুগে আরব সমাজে বিবাহ প্রথা বলে কোন সুনির্দিষ্ট প্রথা ছিল না। সেই সময় আরবের পুরুষরা চাইলে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতো। তাদেরকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে আবার বর্জন করতো। অবৈধ মিলন ও বহু রক্ষিতা রাখতো।
অবাধ ব্যভিচারঃ জাহেলি যুগে ব্যভিচারের মতো একটি র্ঘণ্য ও জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত থাকতো প্রায় সকল শ্রেণির মানুষরাই। নারীরাও একাধিক স্বামী গ্রহণ করতো। নারীরা বহুপতি গ্রহণ করতো ও ব্যভিচারে লিপ্ত হতো। শুধ তাই নয়, সেই সময় ভাই-বোন বিয়ে, ভগ্নীকে বিয়ে ও বিমাতাকে বিয়ে করার কুপ্রথা প্রচলিত ছিল।
নিকাহে ইসতিবযাঃ নারী-পুরুষের বিবাহের দ্বিতীয় প্রথাকে বলা হতো ‘নিকাহে ইসতিবযা’। নারী ও পুরুষের মিলনের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকতো জ্ঞানী, গুণী ও শক্তিধর কোন সুপুরুষের সাথে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শ্রেণির সন্তান লাভ করা।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যখন কোন মহিলা ঋতুজনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতো, তখন তার স্বামী তাকে পছন্দমত কোন সুপুরুষের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠাতে বলতো। এই অবস্থায় স্বামী তার নিকট থেকে পৃথক হয়ে থাকতো ও কোন ক্রমেই তার সাথে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতো না।
আর স্ত্রীকে দেয়া প্রস্তাব স্বীকৃতি লাভ করলে গর্ভধারণের সুস্পষ্ট আলামত প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত থাকতো। তারপর গর্ভধারণের আলামত সুস্পষ্ট হলে সে তার স্বামীর সাথে মিলিত হতো।
পতিতাবৃত্তিঃ নারী-পুরুষের ‘বিয়ে ও মিলন’ নাম দিয়ে আরো একটি জঘন্য ধরনের অশ্লীল প্রথা জাহেলি যুগে আরব সমাজে প্রচলিত ছিল। এতে কোন মহিলাকে কেন্দ্র করে অনেক লোক একত্রিত হতো এবং পর্যায়ক্রমে তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতো।
এরা হচ্ছে পতিতাবৃত্তি পেশা অবলম্বনকারী মহিলা। সুতরাং দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোন লোক তাদের নিকট আসলে তারা আপত্তি করতো না। এছাড়া বাড়ির প্রবেশদ্বারে পতিতাবৃত্তির প্রতীক হিসেবে এক ধরনের নিশান দিয়ে রাখতো, যাতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা নির্দিধায় সেখানে আসা-যাওয়া করতে পারতো।
দলগত বিবাহ প্রথাঃ আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে দলগত বিবাহ প্রথার প্রচলন ছিল। সে সময় তথাকথিত ‘বিয়ে’ নামক নারী-পুরুষের মিলনের তৃতীয় প্রথা মারাত্মক ও জঘন্য একটি রীতি ছিল। তখন দশের চেয়ে কম সংখ্যক পুরুষের সমন্বয়ে একটি দল গঠিত হতো এবং তারা সকলে পর্যায়ক্রমে একই মহিলার সাথে সঙ্গম ক্রিয়ায় লিপ্ত হতো।
এর ফলে উক্ত মহিলা গর্ভধারণের পর যথা সময়ে সন্তান প্রসব করতো। এর কয়েক দিন পর উক্ত মহিলা পচলিত নিয়মে বাধ্যগতভাবে উক্ত দলকে ডেকে উপস্থিত করতো। তারপর তাদের সকলের মধ্য থেকে একজনকে লক্ষ করে বলতো, “হে অমুক! আমার এ গর্ভজাত সন্তান হচ্ছে আপনারই সন্তান”।
মহিলার এ ঘোষনা দেওয়ার সাথে সাথে উক্ত পুরুষ এই সন্তানকে তার সন্তান হিসেবে মেনে নিতো এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই তার স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য থাকতো।
যখন মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে রাসূলরুপে প্রেরণ করলেন, তখন জাহেলি যুগের সকল ধরনের অশ্লীল বৈবাহিক প্রথার অবসান ঘটলো। বর্তমানে ইসলামি সমাজে যে বিয়ে প্রথা প্রচলিত রয়েছে, তা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে রাসূল (সাঃ) আরব সমাজে সে ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করেন। (সহিহ বুখারি, বিবাহ পর্ব, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৬৯, এবং আবু দাউদ, বিবাহর পদ্ধতি সমূহ’র অধ্যায়)
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানের অবস্থা
কখন কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো? আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানের অবস্থা কেমন ছিল? তা জেনে নিন এই পোস্টটি পড়ে। এখন আমি আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানের অবস্থা যে কত ঘৃণ্য ও মর্মান্তিক ছিল, তা নিয়ে যথাসম্ভব আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশায়াল্লাহ।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানের ব্যাপারে তৎকালীন আরব সমাজের লোকেরা নারকীয় দুষ্কর্ম করতে তারা এতটুকু দ্বিধাবোধ করতো না। সমাজের লোকলজ্জা ও নিন্দার ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত অবস্থায় মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হতো।
কন্যা সন্তানের উপর যে ঘৃণ্য জুলুম করা হতো, সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সূরাঃ আন-নাহল এর ৫৮-৫৯ নং আয়াতে আল্লাহপর এরশাদ করেন-
وَاِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمۡ بِالۡاُنۡثٰى ظَلَّ وَجۡهُهٗ مُسۡوَدًّا وَّهُوَ كَظِيۡمٌۚ
অর্থঃ “তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় আর সে অন্তর্জ্বালায় পুড়তে থাকে।”
يَتَوَارٰى مِنَ الۡقَوۡمِ مِنۡ سُوۡۤءِ مَا بُشِّرَ بِهٖ ؕ اَيُمۡسِكُهٗ عَلٰى هُوۡنٍ اَمۡ يَدُسُّهٗ فِى التُّـرَابِ ؕ اَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُوۡنَ
অর্থঃ “লজ্জায় সে মানুষ থেকে মুখ লুকায় খারাপ সংবাদ পাওয়ার কারণে। সে চিন্তা করে যে অপমান মাথায় করে তাকে রেখে দেবে, না তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। হায়, তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কতই না জঘন্য!”
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানকে যেখানে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, সেই জায়গাটি হলো মসজিতে হারামের পাশে একটি খালি জায়গা ঘিরে রাখা আছে, সেখানেই জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। এই খালি জায়গাটিতেই জাহেলিয়া যুগের লোকেরা তাদের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতো। জায়গাটি পাথুরে আর বালুকাময়। অনেক দর্শনার্থী সেখানে গিয়ে চোখের পানি ফেলে দোয়া করে আসেন।
এ ছিল আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সাধারণ চিত্র। সেখানে না ছিল কোন শিক্ষা-দীক্ষার আলো, না ছিল কোন ছিল কোন পয়গম্বার এর আগমন। তাই সেই সময় কন্যা সন্তানকে তারা মানুষ হিসেবে কোন সামাজিক স্বীকৃতি দিতো না। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা হয়েছে উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত আর করুনার পাত্রী।
কারো সংসারে কোন কন্যা সন্তান জন্ম নিলে, এটাকে তারা অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে মনে করতো। তাই তারা লজ্জা আর অপমান থেকে রেহাই পাওযার জন্য তাদেরকে জীবন্ত কবর দিতে দ্বিধাবোধ করতো না। এটাকে তারা বৈধ মনে করতো এবং তাদের মনে এ নিয়ে কোন অনুশোচনাও থাকতো না।
ইসলামের আবির্ভাবের পর ইসলাম গ্রহণ করে তামিম গোত্রের প্রধান কায়েস বিন আসাম যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট কথা প্রসঙ্গে তার নিজ হাতে কিভাবে তার নিজের জীবন্ত কন্যাকে মাটির নিচে চাপা দিলেন তার বর্ণনা করলেন। মেয়েটি কিভাবে বাবা-বাবা চিৎকার করছিল, ফরিয়াদ করছিল তার বর্ণনা দিলেন। তার মুখে এই করুন মর্মাহত বর্ণনা শুনে নবী করিম (সাঃ) - এর দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধার বয়ে চলছিল, তাঁর দাড়ি মোবারক ভিজে গিয়েছিল।
ইসলামে কন্যা সন্তান ও নারীর মর্যাদা
কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র কুরআন মাজিদে এরশাদ করেছেন,
অর্থঃ “আর যখন আত্মাগুলোকে সমগোত্রীয়দের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হবে। যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? আর যখন আমলনামাগুলো উন্মোচিত করা হবে।” (সূরাঃ আত-তাকভীর, আয়াতঃ ০৭-১০)
এর অর্থ হলো, হাসরের ময়দানে যখন লোকদেরকে একত্রিত করে ঈমান ও কর্মের দিক দিয়ে শ্রেনীবিভাগ করা হবে। তখন এক জায়গায় কাফের আর অন্য জায়গায় মুমিন থাকবে। সেই সময় জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। মৃত্যুর পর মানুষের আমলনামা গুটিয়ে দেওয়া হবে এবং পুনরায় কিয়ামতের দিন হিসাবের জন্য তা খেলা হবে। আর প্রতিটি ব্যক্তি তা দেখতে পাবে ও তার হাতে তা ধরিয়ে দেওয়া হবে।
কন্যা সন্তান সম্পর্কে হাদিসঃ কন্যা সন্তান সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, “যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলো, অতঃপর সে তার কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার উপর প্রাধান্য দেয়নি, তাহলে ঐ কন্যার কারণে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (মুসনাদ আহমদ, হাঃ ১ঃ২২৩)
একদা আয়েশা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে এক নারী ও তার দুই কন্যার অভাব-অনটনের কথা বললে রাসূল (সাঃ) বলেন, “ যাকে কন্যা সন্তান দিয়ে কোন কিছুর মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়, আর সে তাদের প্রতি যথাযথ আচরণ করে, তাহলে তা তার জন্য আগুন থেকে রক্ষাকারী হবে।” (মুসলিম, হাঃ ৬৮৬২)
কন্যা সন্তান সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালন পালনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আর সে ধৈর্যের সাথে তা সম্পাদন করেছে। সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় হবে।” (তিরমিজি, হাঃ ১৯১৩)
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি দুইটি মেয়ে সন্তানকে লালন-পালন করবে, আমি এবং সে এভাবে একসাথে পাশাপাশি জান্নাতে যাবো। এই বলে তিনি নিজের দুইটি আঙ্গুল একত্র করে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন।” (তিরমিজি, হাঃ ১৯১৪)
ইসলামে নারীর মর্যাদাঃ জাহেলিয়া যুগে নারীরা যেসব শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা, অবজ্ঞা, পাপাচার, অত্যাচার, ব্যভিচার, নির্যাতনের শিকার ছিল, ইসলামের আবির্ভাবের পর তারা পূর্ণ মর্যাদা ও গৌরবময় জীবনযাপনের সামাজিক অধিকার ফিরে পেয়েছে।
ইসলাম নারীদেরকে যেভাবে জীবনের শুরুতে কারো কন্যা, যৌবনে এসে সে কারো স্ত্রী এবং জীবনের শেষ বেলায় এসে তারা কারো মমতাময়ী মা হিসেবে যে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যসব প্রচলিত ধর্ম থেকে সত্যই বিরল।
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থাকে কোন ভাবেই সামাজিক অবস্থার চেয়ে উন্নত বলা যেতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, ব্যবসা-বাণিজ্যই ছিল আরব অধিবাসীগণের জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন। মরুময় পথে গমনাগমন এবং মালপত্র পরিবহনের জন্য একমাত্র মাধ্যম উটের পিঠে যাতায়াত ও মালপত্র পরিবহনের ব্যবস্থাটি ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
এছাড়া পথও ছিল অত্যন্ত দুর্গম ও বিপদ-সংকুল। তাই সবদিক দিয়ে সুসজ্জিত বড় বড় কাফেলা ছাড়া পথ চলার কথা চিন্তাই করা যেত না। আবার দস্যুদল কর্তৃক আক্রান্ত ও সর্বস্ব হারাবার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হতো কাফেলার সকলকে।
আরব ভূ-খন্ডের অভ্যন্তরভাগের লোকেরা প্রায় সকলেই পশু পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। মরুপ্রান্তরের আনাচে-কানাচে যেসব স্থানে চাষের উপযোগী ভূমি পাওয়া যেত, সেখানে কৃষির ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু অর্থনৈতিক যে সমস্যাটি সবচেয়ে জটিল ছিল তা হচ্ছে, মানুষের দরিত্রতা দূরীকরণের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন, মহামারী ও রোগব্যাধি দূরীকরণ কিংবা অন্য কোন কল্যাণমূলক কাজে অর্থ-সম্পদের খুব সামান্য অংশই ব্যয় হতো। সম্পদের সিংহভাগই ব্যয় হতো যুদ্ধবিগ্রহের কাজে।
শেষ কথা
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা- পর্ব-০৬ হিসেবে আজকে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা, জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে কন্যা সন্তানের অবস্থা কেমন ছিল? আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীর অবস্থা কেমন ছিল? তা নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরেছি।
আশা করি, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অনেক তথ্যই আপনি জানতে পেরেছেন। আর ইসলামের আবির্ভাবের পর কন্যা সন্তান ও নারী সম্পর্কে যে মর্যাদা প্রকাশ পেয়েছে, সে সম্পর্কেও কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আর এই তথ্য গুলো আমাদের সমাজে সকলেরই জানা খুবই প্রয়োজন।
তাই শেষ কথা হিসেবে বলতে চাই, আজকের পোস্টটি পড়ে যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, যদি এই তথ্যগুলো আর কাউকে আপনি জানাতে চান, তাহলে অবশ্য পোস্টটি আপনার স্যোসাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন, যাতে অন্যেরাও পড়ে উপকৃত হতে পারে। এতক্ষুণ এই পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। (শওকত রাশেল)
ওয়ানলাইফ আইটিরনীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url